দিদারুল: আত্মত্যাগ—সম্মানে মোড়ানো এক বীর
শাহ্ সুমন, নিউইয়র্ক

বাংলাদেশেরে একটি মফস্বল শহর থেকে স্ব—পরিবারের ১৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কে এসেছিলেন দিদারুল ইসলাম রতন। নিউইয়র্কে এসে রেস্টুরেন্টে কাজের মাধ্যমে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন এবং পাশাপাশি পড়াশুনাও চালিয়ে যান তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিলো কমিউনিটির কল্যাণে দায়িত্বশীল এবং পেশাদারিত্ব একটি কর্মক্ষেত্রে যোগদান। সেই লক্ষ্যে তিনি নিজেকে গড়েছেন। সাড়ে তিন বছর আগে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা পুলিশ প্রশাসন নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেন দিদারুল। যোগদানের পর থেকেই তিনি দায়িত্ব এবং পেশাদারিত্বে অটুট রেখেছেন নিজেকে। সেই দায়িত্ব, নিষ্ঠা আর পেশাদারিত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতে পিছপা হননি দিদারুল।
২৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ছয়টার দাত্বিরত অবস্থায় নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের পার্ক অ্যাভিনিউয়ে এক অস্ত্রধারীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে ওই বন্ধুকধারী গুলিতে তিনি বীরের মতো নিহত হন। নিজের জীবন বিসর্জনে তাঁর অনাগত সন্তান সহ দুই ছেলে, স্ত্রী, পিতা—মাতাসহ পরিবারের লোকজন ও এনওয়াইপিডি পুলিশ হারালো দায়িত্ববান অকুতভয় দিদারুলকে। দিদারুলের এমন আত্মত্যাগে পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সিনেট, কংগ্রেস, নিউইয়র্ক স্টেট গভর্ণর, সিটি মেয়র, এনওয়াইপিডি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট দিদারুলের আত্মত্যাগকে বীর উপাধি দিয়ে সম্মান জানান। তাঁর এ আত্মত্যাগে শুধু নিজের প্রতি নয়, নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশকেও বিশ্বের কাছে সম্মানের শিখরে নিয়ে গেছেন দিদারুল।
তাঁর আত্মত্যাগে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বমহলে বাংলাদেশ নামটি প্রশংসার সাথে উচ্চারিত হয় বার বার। দিদারুলের মতো নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল একজন পুলিশ সদস্যকে হারিয়ে এনওয়াইপিডি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ‘বীর’ উপাধী এবং মরোণত্তর ফাস্ট গ্রেড ডিটেকটিভ কর্মকর্তার পদমর্যাদায় ভূষিত করা হয়। গর্ভর্ণর ক্যাথি হোকুল, মেয়র এরিক অ্যাডামস, পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশসহ হাজার হাজার এনওয়াইপিডি পুলিশ, নিউজার্সি স্টেট থেকে আগত পুলিশ কর্মকর্তারা ও ৩০/৩৫ হাজার মানুষে উপস্থিতিতে জানাজায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ও সম্মানে শেষ বিদায় জানানো হয় দিদারুল ইসলামকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি প্রথম কোন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুতকে এমন রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পুরো বিশ্ব দেখলো দিদারুলে আত্মত্যাগ। আত্মত্যাগ—সম্মানে মোড়ানো এক বীর দিদারুলের শেষ বিদায়ে কেঁদেছিলো জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষ। ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে শেষ বিদায়ের সময় দিদারুলে দুই সন্তানের অশ্রম্নজল আকাশের মেঘও অঝোর ধারায় বৃষ্টির কান্নায় পরিণত হয়। সেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দিদারুলের পরিবার, বন্ধু স্বজন, সহকর্মীরা তাঁকে অশ্রম্নজলে শেষ বিদায় জানান। এমন প্রস্থানে আত্মত্যাগ—সম্মানে মোড়ানো বীরের বেশে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইতিহাস হয়ে থাকবেন দিদারুল। তবে আক্ষেপ কিছুটা থেকেই যাবে। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে জন্মভূমিকে সন্মানীত করলেও সেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোন বিবৃতি ও শ্রদ্ধা জানানো হয়নি। শুধু নিয়ম রক্ষার্থে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট কর্মকর্তা জানাজায় উপস্থিত হোন। এছাড়া বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
দিদারুলের পিতা আব্দুর রব আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলের আত্মত্যাগে নিউইয়র্ক সিটি ও এনওয়াইপিডিসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্র যে সম্মান দিয়েছে সেজন্য আমি গর্বিত। সে আমার ও বাংলাদেশের সম্মান বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে নিজের জীবন দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দূতাবাস কিংবা কনস্যুলেট থেকে কেউ খোঁজই নিলেন না।
বাংলাদেশ—আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশন (বাপা)’র নেতৃবৃন্দরা জানান, দিদারুল ইসলাম নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যোগদানের পর থেকেই ছিলেন দায়িত্বশীল। তিনি নিষ্ঠা ও নিউইয়র্ক বাসীকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এনওয়াইপিডি এজন্য তাঁকে বীর উপাধী এবং ডিটেকটিভ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে (মরোণত্তর) পদোন্নতি ও রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছে। একজন বাংলাদেশি—আমেরিকান হিসেবে দিদারুল বিশ্বের কাছে বীরের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গত বৃহস্পতিবার ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার এলাকায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামকে (৩৬) আনুষ্ঠানিকভাবে শেষবিদায় জানানো হয়।
শেষবিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় দিদারুলকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (এনওয়াইপিডি)। তাঁকে মরণোত্তর ‘ডিটেকটিভ ফাস্টর্ গ্রেড’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
দিদারুলের বীরত্বের স্বীকৃতি দিতে, তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা দেখাতে এ আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন গভর্ণর ক্যাথি হোকুল, সিটি মেয়র এরিক অ্যাডমস, এনওয়াইপিডির কমিশনার জেসিকা টিশ, সাবেক গভর্ণর অ্যান্ড্রু কুয়োমো, ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানী সহ নিউইয়র্ক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ব্রঙ্কসের পার্কচেষ্টারে ইসলামিক সেন্টারে উপস্থিত হোন।
দিদারুলের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার সন্তানরা তাদের পিতাকে হারিয়েছে। আমি স্বামী হারিয়েছি। আমাদের পরিবারে অভিভাবককে হারিয়েছি। তাঁকে হারানো বেদনা আমি ও আমার সন্তানরা আজীবন বয়ে বেড়াবো। কিন্তু গর্ব এটাই আমার স্বামী নিউইয়র্কবাসীকে নিরাপদ রাখতে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। আমার সন্তানরা যখন বুঝতে পারবে তাদের পিতা নিউইয়র্কবাসীকে নিরাপদ রাখতে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছেন, তখন হয়তো তাদের আক্ষেপ ও পিতা হারানোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।
এনওয়াইপিডির কমিশনার জেসিকা টিশ বলেন, দিদারুল নিজের জীবন দিয়ে অন্যদের রক্ষা করেছেন। তিনি এক নিঃস্বার্থ বীর।
সিটি মেয়র অ্যাডমস বলেন, দিদারুল আমাদের হিরো। নিউইয়র্কবাসীকে নিরাপদ রাখতে সে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তাঁর এমন আত্মত্যাগে একজন বীরকে হারালাম। এই নিউইয়র্কে তাঁর নাম ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
গভর্ণর ক্যাথি হোকুল বলেন, দিদারুল নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও অস্ত্রধারীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বীরত্বের প্রমাণ দেখিয়ে গেলেন। তিনি আমাদের গর্ব।
দিদারুলের জানাজা পার্কর্চেস্টার জামে মসজিদে হয়। তাঁর জানাজায় হাজারো মুসল্লি অংশ নেন। জানাজা শেষে নিউজার্সির টোটোওয়া ইসলামিক কবরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এর আগে স্থানীয় সময় গত সোমবার নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের পার্ক অ্যাভিনিউয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন দিদারুল। পার্ক অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতল ভবনে ঢুকে রাইফেল থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকেন এক তরুণ। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হামলাকারীকে থামাতে গিয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে দিদারুল নিহত হন।
এনওয়াইপিডির কমিশনার জেসিকা টিশ গণমাধ্যমকে জানান, ঘটনা ঘটানোর এক ঘণ্টা আগে শেন তামুরা লাস ভেগাস থেকে নিউইয়র্কে আসেন। তামুরা বহুতল করপোরেট ভবনের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। এ ঘটনায় দিদারুল সহ ৪ জন নিহত হন। পরে শেন তামুরা নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেন। প্রাথমিক তদন্তে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দিদারুলের বাড়ি বাংলাদেশে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌর শহরের মাগুরায়। ২০০৯ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য স্ব—পরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আসেন দিদারুল। ব্রঙ্কসে পিতা—মাতা, স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি।
আমেরিকা এর আরো খবর

ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই ৫৪ শতাংশের / নিউইয়র্কে ৫ মাসে ২ সহস্রাধিক অভিবাসী গ্রেপ্তার

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে নিউইয়র্কবাসীকে মেয়র অ্যাডামসের আহ্বান

বন্ধ হয়ে যাবে মাসিক আনলিমিটেড ভ্রমণ সুবিধা / জানুয়ারিতে বাড়ছে নিউইয়র্ক সিটির সাবওয়ে ও বাস ভাড়া

অভিযুক্ত মেয়র ও পুলিশ কমিশনার / নিউ ইয়র্কের ‘স্যাঙ্কচুয়ারি’ আইনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের মামলা

মামদানি মেয়র হলে নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডা চলে যাবো : অ্যান্ড্রু কুওমো
